বাংলাদেশে খতিয়ান এবং ভূমি জরিপের ইতিহাস ও প্রকারভেদ
খতিয়ান কী? ভূমি জরিপকাল সহ মৌজা ভিত্তিক এক বা একাধিক ভূমি মালিকের ভূ-সম্পত্তির বিবরণকে খতিয়ান বলে।
খতিয়ানের সংজ্ঞা থেকে যেসব প্রশ্ন তৈরি হতে পারে-
১. মৌজা কাকে বলে?
যখন Cadastral Survey (CS) জরিপ করা হয় তখন থানা ভিত্তিক, এক বা একাধিক ইউনিয়ন, গ্রাম,মহল্লা,পাড়াকে আলাদাভাবে ভাগ করে নাম্বার দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। সে আলাদা করা এক বা একাধিক ইউনিয়ন, গ্রাম, মহল্লা, পাড়া নিয়ে মৌজা গঠিত হয়।
২.ভূমি জরিপ কী?
ভূমি জরিপ হচ্ছে বিভিন্ন মৌজায় নকশা বা ম্যাপ যাচাই-বাছাই করে সংশোধন করে নতুন নকশা প্রনয়ণ করা। বিস্তারিতভাবে বললে কোন মৌজার জমির আকার পরিবর্তন হয়েছে বা মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে সেসবের সাথে সামঞ্জস্য রেখে যাচাই-বাছাই করে নতুন নকশা তৈরিকে ভূমি জরিপ বলে।
এ পর্যন্ত কতবার ভূমি জরিপ হয়েছে?
এ পর্যন্ত চারবার ভূমি জরিপ হয়েছে, নিম্নে দেয়া হলোঃ-
১.সি. এস খতিয়ান
১৯১০-১৯২০ সালের মধ্যে সরকারি আমিনরা প্রতিটা মৌজার নকশার অধীনে ভূমিখণ্ড পরিমাপ করে তার মালিকানা বিবরণ করে অতঃপর জরিপকৃত ভূমিসমূহের মালিক বা শরিকগণের নামে একটি রেজিস্টার (খতিয়ান) প্রস্তুত ও সংরক্ষণ করা হয়।
সি.এস খতিয়ান চেনার উপায়:-
১.সি এস খতিয়ান উপর নীচ লম্বালম্বি হয়
২.দেখতে লিগ্যাল সাইজ কাগজের মত
৩.সি এস খতিয়ানের উভয়পৃষ্ঠায় লেখা থাকে
৪.সি.এস খতিয়ানের প্রথম পৃষ্ঠায় উপরে পরগণা কথা লেখা থাকবে এবং অপর পৃষ্ঠায় দাগ ও জমির পরিমান, জমির রকম কলামের পাশেই উত্তর সীমানার মালিকের পরিচয় উল্লেখ থাকবে। খতিয়ানের প্রথম পৃষ্ঠায় দুইটি ভাগ আছে, উপরের অংশে জমিদারের এবং নীচের অংশে প্রজা বা রায়তের নাম ঠিকানা ও হিস্যা উল্লেখ থাকে, যা অন্য কোন জরিপে থাকে না।
২.এস.এ খতিয়ান (State Acquisition)
১৯৫০ সালের জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে সরকার জমির মালিকানা অধিগ্রহণ করে। কিন্তু সরকার জমিদারের নিকট হতে কি পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করেছে এবং তার ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের জন্য ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে স্বল্প পরিসরে একটি জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে। যাকে এস.এ জরিপ নামে আখ্যায়িত করা হয়।
এস.এ খতিয়ান চেনার উপায়ঃ-
১.এস.এ খতিয়ান এক পৃষ্ঠার ল্যান্ডস্কেপ বা ডানে-বামে আড়াআড়ি হয়।
২.এই খতিয়ানের অধিকাংশই হস্তলিখিত, তবে ঢাকাসহ পার্শ্ববর্তী কিছু এলাকায় প্রিন্টেড এস.এ খতিয়ান পাওয়া যায়। এই পর্চায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অংশীদারদের ষোল আনা অংশ প্রাপকদের মাঝে পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়নি। উপরের বাম পার্শ্বে সাবেক এবং এর নিচে হাল লিখে খতিয়ান নম্বর লিখা থাকতে পারে কিংবা শুধু সাবেক লিখা থাকতে পারে। সর্বশেষে মন্তব্য কলাম ও তার পার্শ্বে রাজস্ব কলাম অবস্থান করে
৩.আর.এস খতিয়ান (Revisional Survey)
ভূমি রাজস্ব প্রশাসন তদন্ত কমিটির পরামর্শ মোতাবেক ১৯৫০ সালের জমিদারী অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের বিধান অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তান সরকার বিশ বছরের প্রেক্ষিতে পরিকল্পনার আওতায় সমগ্র দেশে সংশোধনী জরিপ কাজ সমাপ্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালের মধ্যে সমগ্র দেশে জমিদারী অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৫ম খন্ড কার্যকর হওয়ার পর সরকার খতিয়ান হালনাগাদের উদ্দেশ্যে সংশোধনী জরিপ (আর.এস) কার্যক্রম গ্রহণ করেন।
১৯৬৫-৬৬ সনে রাজশাহী জোনে প্রথম সংশোধনী কাজ শুরু করা হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে ঢাকা, চট্টগ্রাম, পাবনা, কুষ্টিয়া ও ময়মনসিংহ জোনে সংশোধনী জরিপ (আর.এস) শুরু হয়। এর মধ্যে রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও কুষ্টিয়া জোনের চূড়ান্ত প্রকাশনার কাজ সমাপ্ত করে রেকর্ডপত্র জেলা প্রশাসকের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে।
আর.এস খতিয়ান চেনার উপায়ঃ-
১.আর. এস খতিয়ান সর্বত্রই প্রিন্টেড এবং এটি দেখতে ল্যান্ডস্কেপ হলে এক পৃষ্ঠায় হবে, আর উপর-নিচ হলে দুই পৃষ্ঠা সম্বলিত উভয় প্রকারই হতে পারে।
২.এই খতিয়ানে অংশ কলামে ষোলআনা অংশ মালিকদের নামে আলাদা আলাদা বণ্টন করে উল্লেখ করা থাকবে। এতে অংশ কলাম ও রাজস্ব কলাম পাশাপাশি অবস্থান করে। ১৯৮২ সনের পরের আর. এস খতিয়ানে থানা কথাটির পার্শ্বে উপজেলা শব্দটি লিখা থাকবে।
৪.বি.এস জরিপ (Bangladesh Survey)/ সিটি জরিপ (City Survey)
বাংলাদেশ সার্ভে এর সংক্ষিপ্ত রূপ। ১৯৫০ সালের জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন অনুযায়ী এই জরিপ কার্য পরিচালিত হয়। ১৯৯৮-৯৯ সাল হতে বর্তমানে চলমান জরিপকে বি. এস খতিয়ান বা সিটি জরিপ বলা হয়। যাহা এখনও সারা দেশে চলমান। শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরীতে বি. এস খতিয়াকে সিটি জরিপ বলা হয়। এই সিটি জরিপের আরেক নাম ঢাকা মহানগর জরিপ। আর. এস জরিপের পর বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৮ সাল থেকে এ জরিপের উদ্যোগ নেয়। এ যাবৎকালে এটিই হলো আধুনিক ও সর্বশেষ বিজ্ঞানসম্মত জরিপ বলা হয়।
চেনার উপায়ঃ-
১.বি. এস খতিয়ান বা সিটি জরিপ এক পৃষ্ঠার ল্যান্ডস্কেপ বা ডানে-বামে আড়াআড়ি হবে এবং জরিপের পর্চা শতভাগ কম্পিউটার প্রিন্টেড হবে।
২.এই খতিয়ানে জমির ধরণ যেমন নাল, পুকুর ইত্যাদি উল্লেখ থাকবে।
৩.খতিয়ানটিতে মোট ১২টি কলাম থাকবে। বি. এস খতিয়ান বা সিটি জরিপ দেখতে অনেকটাই একই রকম।
৪.সিটি জরিপ শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই খতিয়ানের উপরে বি. এস খতিয়ান বা সিটি জরিপ কম্পিউটারে টাইপকৃত থাকবে।
-জুয়েল রানা
(আইন সহায়তা)
তথ্যসূত্রঃ-
পোস্টটি লেখার জন্য কিছু অংশ "দি বাংলাদেশ টুডে" অন-লাইন পত্রিকার ২০ মে ২০১৯ সনের আইনজীবী 'মাহফুজার রহমান ইলিয়াস' এর কলাম থেকে নেয়া হয়েছে।